ছুটি

আমি অর্ক। ক্লাস ফাইভে পড়ি। ফাইনাল পরীক্ষার পর লম্বা ছুটি। আমি আর মা গ্রামে এসেছি। এবার মামা বাড়ি। প্রতিবার এই সময়টা দারুণ কাটে। বাবা আসলে আরও মজা হতো।

এখানে স্কুল নেই। হোমওয়ার্ক নেই। ঢাকার জ্যামে আটকে পড়া নেই। খুব সকালে মায়ের ডাকাডাকি নেই। আমি তো রোজই গাড়িতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্কুলে যাই। মা ঘুমের মধ্যেই খাওয়ায়। একদম ভালো লাগে না। স্কুলে অবশ্য অনেক মজা করি। ক্রিকেট খেলতে খুব ইচ্ছে করে। আমাদের স্কুলে মাঠ নেই তো, তাই পারি না। রিমি, রাজু, মানিক, শান্তকে খুব মিস করছি।

আমরা এসেছি বলে দাদু-দিদা খুব খুশি। মা আমাকে বকার সাহসই পায় না। তাই, আমাকে আর পায় কে? মা একবার চড় মারতে মাত্র হাত তুলেছিল। দিদা পিছন থেকে এসে মায়ের দুই কান ধরে মলে দিয়েছিল। আমি মামা আর দাদু খুব হেসেছিলাম। মা বললো, চলো, আগে ঢাকায় ফিরি! তখন দেখবো কে ঠ্যাকায়?

মামার ভার্সিটিও বন্ধ। বিকেল হলেই মামার সাথে হাটে যাই। গরম গরম পাঁপড়, তিলের খাজা খেতে দারুণ লাগে। বড়রা কেউ আমাকে নাম ধরে ডাকে না। কেউ বলে দাদুভাই, কেউ বলে ভাগ্নে। কোন কোন দাদু আবার কান ধরে টেনে দেয়।

আসল কথা তো বলাই হয়নি। আমার দাদু। যেন একটা গল্পের লাইব্রেরি। পরীর গল্প, ভূতের গল্প, জন্তু-জানোয়ােরর গল্প, রাজকন্যার গল্প সবই জানে দাদু। একদিন বললাম, দাদু, এতো গল্প তোমার মনে থাকে? দাদু বললো, আরও কতো গল্প জানতাম। চুলের সাথে সাথে অনেক গল্পও হারিয়ে গেছে। দাদু খুব মজার মজার কথা বলে।

দাদুর একটা দোষও আছে। আমাকে চান্স পেলেই ক্ষ্যাপায়। একদিন একটা ধঁাধা জিজ্ঞেস করলো।
বলো তো দাদুভাই, তোমার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কী?
তুমি বুড়ো, আর আমি ছোট মানুষ।
হয়নি।
তাহলে কী? তোমার মাথা টাক আর আমার মাথা চুলে ভরা?
হয়নি, হয়নি।
আরে কোনটা তাহলে? গ্রাম আর শহর নিয়ে? তুমি গ্রামে থাক আর আমি শহরে?
তাও নয়।
তবে কী
আমার বউ আছে, তোমার নেই!

মনে হলো, বউ না থাকাটা খুব খারাপ। আমি হেরে গেলাম? সাথে সাথে দিদা এগিয়ে এলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, কে বলেছে তোমার বউ নেই? আমিই তোমার বউ। বয়েই গেছে ঐ বুড়োর বউ হতে! আমার কচি বর চাই।

আমিও একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। দাদুকে খেপানোর জন্যে একটা ছড়া মনে পড়ে গেল;
পরান দাদু
ফোঁকলা দাঁতে
খাচ্ছে মুড়ি,
পেছন থেকে
হয়ে গেলো
বউ চুরি।

মায়েদের খেপানোর জন্যে আরেকটা আছে;
মাগো তোমার
বাবার হলো
বউ চুরি,
তোমার মাকে
বউ বানিয়ে
তাই ঘুরি!

মাকে বলতেই মারতে আসলো। জানি, ভয় দেখাচ্ছে। মারবে না। দিদার ভয় আছে না? তবু দৌড় দিলাম। এটা একটা মজা আর কি! সবচে মজা আজ দাদুকে তর্কে হারিয়ে দেওয়া। ধন্যবাদটা অবশ্য দিদারই পাওয়া উচিৎ।

রাত্রে আবার তর্কের আসর বসলো। শোনার মানুষও পাওয়া গেলো। মা, দিদা আর ছোট মামা। দাদু শুরু করলো,
- নৌকায় চড়ে বৈঠা মেরে ঘুরে বেড়ানো। বিলের তাজা তাজা মাছ। শহরে কোথায় পাবে এসব? শহরে শালা মানুষ থাকে নাকি!
- তোমরা তো কেবল বৈঠা ঠেলে মর। আর আমরা চড়ি স্পিড বোটে। নাম শুনেছো? আর বাজারে তো সব মাছই পাওয়া যায়। বাবার সাথে গিয়ে দেখেছি না?
- তাই দিয়ে কি আর মন ভরে? আহ! তাজা তাজা মাছের ঝোল!
- তুমি তো শুধু ওই ঝোলই চেনো। ফিশ ফিলে খেয়েছো? দোপঁেয়াজো?
- আরে, রাখো তোমার ফিসফিলে! পিঠা-পুলি আছে শহরে?
- কয় রকম খাবে বল? দেশী না বিদেশী? একশো রকমের কেক পাবে ঢাকায়। ডিজাইন দেখলেই তুমি পাগোল হয়ে যাবে!
- সে তো গেলো খাওয়ার কথা। কোথায় পাবে রূপকথার গল্প? গ্রামে না আসলে কে শোনাতো ওসব? আর ভূতের গল্প শুনলে তো বদহজম হয়ে যাবে!
- তোমাদের এখানে বই মেলা হয়? বইয়ের দোকান আছে? আমরা চাইলেই তো কিনে পড়তে পারি। তুমি তো বাংলা ভূতের গল্প জানো। আমি ইংরেজি ভূতের গল্পও জানি।
- আর পল্লীগান? বাউল গানের আসর? এসব আছে শহরে?
- জানো, এখন এম.পি থ্রি সিডি পাওয়া যায়। সব গানের সিডিই পাওয়া যায়।

দাদু বোধহয় এম.পি থ্রি কথাটা বুঝলো না। বলে কি না, এম.পি-রা আবার গান করে নাকি?
- ও বুড়ো, এম.পি নয়। এটা এক ধরণের সিডি। কম্পিউটারে চালাতে হয়। সিডি প্লেয়ারেও চালানো যায়।
- এই আমাকে বুড়ো বললে কেন?
- তুমি তো বুড়োই। (মায়ের ইশারায় বুঝলাম একটা ঝামেলা করে ফেলেছি)
- তোমরা এখন কী খেলছো! ঐ তো মাঠের মধ্যে খুঁটি পুঁতে দৌড়াদৌড়ি। ছোট্ট এক বল নিয়ে যতো পাগলামী! খেলা ছিলো আমাদের সময়। লাঠি খেলা, গাদন খেলা, কুস্তি খেলা- এসব কোনদিন চোখে দেখেছো?
- হা হা হা, দাদু! তুমি অনেক পেছনে পড়ে আছো। আমরা আর এখন মাঠে খেলি না। রোদে পোড়ার দরকার নেই তো। আমরা কম্পিউটার গেমস্ খেলি। ভিডিও গেমস্ খেলি। জানো কীভাবে খেলতে হয়?
- হায় রে কপাল! ঘরে বসে নাকি খেলা হয়? কী কাল যে এলো!

দাদু দেখি তর্ক ভুলে কপাল চাপড়াতে শুরু করলো। ভয় পেয়ে গেলো নাকি? বললাম, দাদু, হেরে গেলে তো?
- হেরে গেলাম মানে? শালা, তোর কাছে হেরে যাবো? তবে সেই গল্প শোন- আমরা মামা বাড়ি যেতাম নৌকায় চড়ে। দল বেঁধে যাওয়ার মজাই আলাদা। ভাদ্র মাসের তেলের পিঠা খেতে খেতে ভাত খাওয়ার কথাই ভুলে যেতাম। আর আমরা কি তোমাদের মতো পাখির মতো একটু খেয়েই উঠে পড়তাম? ভাত খেতাম হাঁড়ি হাঁড়ি! ফিরতাম কমপক্ষে একমাস পর।
- আবার সেই নৌকা ঠেলা? আমরা তো দেশ-বিদেশে ঘুরি! সাগর দেখতে যাই। পাহাড়ে চড়তে যাই। প্লেনে করে পাখির মতো উড়ে যাই। কয়দিন পর চাঁদের বুড়ির সাথে গলাগলি ধরে ছবি তুলতে যাবো। তোমরা পেছনেই পড়ে রইলে!

দাদু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। দিদা থামিয়ে দিয়ে বললো, থাক। আমি যা বোঝার বুঝে গেছি। গো হারা হারলে তো দেখলাম! এবার খাবে চলো।

পরদিন সকালে দিদা রিপোর্ট করলো, দাদু নাকি রাত্রে ঘুমাতে পারেনি। ঘুমের মধ্যে কী সব বকবক করছিলো। আমার কানের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলো, এই, ম্যাজিক দাদুটা কে রে?

খুব অবাক হয়ে গেলাম। ম্যাজিক দাদু এখানেও চলে এসেছে? কেন এলো? ম্যাজিক দাদু তো খারাপ মানুষদের শিক্ষা দেয়। মাথায় টোকা মারলেই খারাপ মানুষ ভালো হয়ে যায়। আর বেশি খারাপ মানুষ হলে লাঠি দিয়ে পেটায়। একবার যে খায়, সাথে সাথে তার বুদ্ধি খুলে যায়। আমার দাদু তো ভালো মানুষ। ঘটনাটা ভালো করে শুনতে হবে।

দাদুই সবাইকে ডেকে জড়ো করলো। দাদুর মনটা একটু খারাপ। আস্তে আস্তে কথা বলছে। বললো,
- সবাই শোন। আমি এই দুই দিনে অনেক কিছু শিখেছি। দাদুভাই আমাকে শিখিয়েছে। আর শিখিয়েছে.........

আমরা সবাই চুপ। আর কে শিখিয়েছে? দাদু বলতে পারছে না কেন? দাদুকেও কি তাহলে মেরেছে ম্যাজিক দাদু?
- আর শিখিয়েছে ম্যাজিক দাদু। সাধুবাবার মতো দেখতে। লম্বা লম্বা চুল-দাড়ি। বড় বড় দুটো চোখ। খুব জ্ঞানী মানুষ। যেখানে যা হয়, সব দেখতে পায়। আমি ঠিক করেছি ওদের সাথেই ঢাকায় যাবো। যা যা জানি না, জেনে আসবো। আর আমার দাদুভাইকেও অনেক কিছু দেখাতে হবে। জেলেদের খবর দিয়েছি। পুকুরে মাছ ধরতে আসবে। নৌকাও একটা ঠিক করেছি। বিকালে নদীতে ঘুরতে যাবো সবাই মিলে। ম্যাজিক দাদু আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আর ভুল করবো না।

খুব অবাক হয়ে গেলো সবাই। দিদা ভয়ে ভয়ে মাকে বললো, জানিস, মরার আগে মানুষের এরকম অনেক কিছু করে যেতে ইচ্ছে করে। আমার খুব ভয় করছে!

আমি ঘটনাটা ঠিকই বুঝতে পারলাম। দিদাকে বললাম, ভয়ের কিছুই নেই। ম্যাজিক দাদু শিশুদের খুব ভালোবাসে। কারও কোন ক্ষতি করে না।

মাছ ধরা অনেক দেখেছি। সেটা টিভিতে। আজই প্রথম পুকুরে তাজা তাজা মাছ লাফাতে দেখলাম। আমারও নেমে যেতে ইচ্ছে করছিলো। মা বললো, খবরদার! তুমি সাঁতার জানো?

দাদু দেখি চোখ মুছতে মুছতে আমার কাছে এলো। আমার হাত ধরে বললো, আমায় ক্ষমা করে দিয়ো, দাদুভাই! তুমি যে সাঁতার জানো না, সেটাও তো খেয়াল করিনি এতোদিন। আমরা বুড়োরা তোমাদের দোষ দিতে খুব পারি। শেখাতে পারি না। আমি আর ভুল করবো না।

বিকালে নৌকায় চড়ে অনেক মজা করলাম। অনেকগুলো ছবি তুললাম। নদীর ধারে একটা হাট বসেছিলো। নৌকা থামিয়ে হাটে বেড়াতে গেলাম। গরম গরম পাঁপড় কিনলাম। দেখলাম, ওখানকার মানুষ খুব গরীব। আমাদের ঘিরে ধরেছিলো অনেক মানুষ। একটা ছোট মেয়ে পাঁপড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো। দাদু ওকে একটা পাঁপড় দিতে গিয়ে আমাকে বললো, দাদুভাই, তুমিই দাও।

যে কয়দিন ছিলাম, দাদু একটা না একটা কিছু আয়োজন করে আমাকে চমকে দিলো। এই যেমন বাউল গানের আসর। আমাকেও তালে তালে নাচতে হলো ওদের সাথে।

ছুটি শেষ হয়ে এলো। এবার ফিরে যেতে হবে ঢাকায়। আবার স্কুল, আবার হোমওয়ার্ক। খুব মনখারাপ হলো। মা বললো, তোমার তো খুশিই হওয়া উচিৎ। এতোটা স্পেশাল ছুটি আর কখনও কাটিয়েছো? পুরো ক্রেডিট দিতে হবে আমার বাবাকে।

আমিও মাকে কথা দিলাম, দাদুকে আর কখনও বুড়ো বলবো না। মজা করেও না।

দাদু এগিয়ে এলো। হাই ফাইভ করলো আমার সাথে। যেন মাত্রই ছক্কা হাঁকিয়েছে। মা দেখি দিদাকে ধরে কাঁদছে। মামা বললো, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো............